এষণা কুন্ডু , নিউজ ডেস্ক ; বড়জোড়ার সাহারজোড়ার জঙ্গলে রাতের অন্ধকার কাটতেই সামনে ধরা দিল এক আদর-ভরা মুহূর্ত। ক্লান্তিতে পথের ধুলোর উপর থেমে পড়েছিল মাত্র ১৫–২০ দিনের একটি কচি হাতির শাবক। পাশে বসে তাকে আগলে রেখেছিলেন তার মা— অটল, অচঞ্চল। দল থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়লেও এক ইঞ্চি দূরেও যাননি তিনি। শাবকের হালকা ডাক শোনামাত্র শুঁড় বাড়িয়ে সাড়া দিচ্ছিলেন মা, যেন বন্যতার গভীরেও মাতৃত্বের নিঃশব্দ স্পর্শ ছড়িয়ে আছে।
বিষ্ণুপুরমুখী পথে এগোচ্ছিল পুরো হাতির দল। কিন্তু ছোট্ট শাবকটির থমকে যাওয়ায় বারবার ব্যাহত হচ্ছিল তাদের যাত্রা। কখনও দাঁড়িয়ে পড়ছে, কখনও হাঁপাচ্ছে— আর প্রতিবারই মা হাতি থেমে তাকে সামলে নিচ্ছেন, যেন তার সম্পূর্ণ পৃথিবীই এই অনিশ্চিত দুটি পা।
রাতভর নজরদারিতে ছিলেন বড়জোড়া রেঞ্জের বনকর্মীরা। দূর থেকে আলো কমিয়ে সুরক্ষিত দূরত্বে দাঁড়িয়ে তারা পর্যবেক্ষণ করছিলেন মা–শাবকের প্রতিটি নড়াচড়া। একজন বনকর্মী বলেন, “হাতিরা চলতে শুরু করার পর থেকেই শাবকটি বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। মা তাকে ছাড়া এক পা নড়ছিল না। তাই আমরা কোনওভাবেই তাদের ওপর চাপ না ফেলে নিরাপদ দূরত্ব থেকেই নজরদারি করেছি।”
ডিএফও শেখ ফরিদ জানান, “শাবকটির বয়স খুবই কম। দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে গিয়ে ওই বয়সে ক্লান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার নিরাপত্তাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছি যাতে মানুষ–হাতির দূরত্ব বজায় থাকে এবং দলের চলার গতিও বজায় থাকে।”
গত কয়েক মাস বড়জোড়া জঙ্গলে অবস্থানের পর হাতির এই বড় দলটি ধীরে ধীরে বিষ্ণুপুরমুখী পথে সরে যাচ্ছে। বন দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বড়জোড়া রেঞ্জে ৫৮–৬৩টি হাতি বিচরণ করছে— সাহারজোড়ায় ৫টি, উত্তর সরাগোড়ায় ১৮টি, পাবয়ায় ১০টি এবং শিউলীবনের গভীরে ২৫–৩০টি। এই দলগুলির গতিবিধি এখন মূলত ঘন জঙ্গলপথ ধরে বিষ্ণুপুর রেঞ্জের দিকে এগোচ্ছে।
বন দফতর স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি ইতিমধ্যেই সতর্কবার্তা জারি করেছে। গভীর জঙ্গলপথে ভোর বা রাতে যাতায়াত এড়াতে বলা হচ্ছে। কারণ এই সময়টি শাবকদের জন্য অত্যন্ত নাজুক। মা হাতি স্বভাবতই উত্তেজিত হতে পারেন, আর অতি কাছে মানুষের উপস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
জঙ্গলের আঁধারে মা–শাবকের পাশাপাশি চলার দৃশ্য এক অনন্য প্রকৃতিচিত্র। শাবক কখনও থামে, কখনও এগোয়— আর প্রতিবারই পাশে থাকে মায়ের নরম শুঁড়ের ছোঁয়া। পথ কতটা দীর্ঘ, জঙ্গল কতটা ঘন, তা জানা নেই কারও। কিন্তু প্রতিটি অনিশ্চিত পদক্ষেপে যে স্নেহের পাহারা রয়েছে, তা যেন ছড়িয়ে পড়েছে বড়জোড়ার জঙ্গলের প্রতিটি বাঁকে।
বন দফতরের বার্তা স্পষ্ট— সতর্ক থাকুন, দূরত্ব বজায় রাখুন, আর এই অসাধারণ বন্য মাতৃত্বের পথচলাই যেন নিঃশব্দে, নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হতে পারে।















