২৬শে নভেম্বর,এষণা কুন্ডু, নিউজ ডেস্ক; শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে সমাজের বিশেষভাবে সক্ষম নারী-পুরুষদের অধিকার ও সরকারি সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ময়দানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বংশীহারির যুবতি রুমানা খাতুন (৩২)। নিজেই জন্মগতভাবে বিশেষভাবে সক্ষম হয়েও জেলার অসংখ্য প্রতিবন্ধী মানুষের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—অন্যদের সুবিধা পাইয়ে দিলেও নিজে এখনও সরকারি কোনও বড় সহায়তা পাননি।
অতি দরিদ্র ঘরে জন্ম, মাত্র তিন ফুট উচ্চতা
রুমানার বাড়ি বংশীহারির মহাবাড়ি পঞ্চায়েতের কাকিহার গ্রামে। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন তিনি; উচ্চতা মাত্র তিন ফুটের মতো। বাবা মোজাম আলি এবং মা ওসামায়ারা বেগমকে নিয়ে তাঁদের সংসার। পরিবারের কাছে মাত্র এক বিঘা জমি, সেই জমিতে চাষ করে অতি কষ্টে সংসার চালান তার বাবা।
দরিদ্র পরিবার, তার ওপর প্রতিবন্ধকতা—সব মিলিয়ে জীবনের প্রথম থেকেই সংগ্রামের মধ্যে বেড়ে ওঠা রুমানা অষ্টম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু থেমে যাননি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নেন।
জেলায় প্রতিবন্ধীদের মুখপাত্র রুমানা
নিজের দক্ষতা ও কর্মঠতার জেরে তিনি এখন সারা বাংলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা কমিটির সদস্য। জেলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে সরকারি পরিষেবা, ভাতা, আবাস, চিকিৎসা সুবিধা—এইসব ডকুমেন্টেশন ও আবেদনের কাজে সহায়তা করেন শত শত প্রতিবন্ধী মানুষকে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি রুমানার জরাজীর্ণ বাড়িতে পৌঁছালে প্রথমে বিস্ময়, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তিনি বলেন,
“কি জানবেন বলুন। দারিদ্র্য আর প্রতিবন্ধকতা আমাদের জীবনের অংশ। জন্ম থেকেই বিশেষভাবে সক্ষম। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি, তারপর আর সম্ভব হয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতা মাসে এক হাজার টাকা পাই, কিন্তু সেই টাকাও নিজের সংগঠনের কাজে বেরোতেই শেষ হয়ে যায়।”
তিনি জানান,
“সপ্তাহে পাঁচ দিন আমাকে জেলার বাইরে ঘুরতে হয়। এত মানুষের কাজ করতে গিয়ে নিজের কথা ভাবার সময় কোথায়! তবুও সরকারি কোনও বড় সুবিধা আমি পাইনি। একবার ট্রাইসাইকেলের জন্য আবেদন করেছিলাম, পাইনি। এখন আর আক্ষেপ করি না। বরং অন্যদের সরকারি সুবিধা পাইয়ে দিতে পারলেই আমার তৃপ্তি।”
পরিবারের দারিদ্র্য ও বহু বছর ধরে বঞ্চনা
রুমানার মা ওসামায়ারা বেগমের কথায় উঠে আসে তাঁদের কঠিন বাস্তবতা।
তিনি বলেন,
“আমার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে রুমানা সবার বড়। অন্য দুই ছেলের আলাদা সংসার। আমরা স্বামী-স্ত্রী অত্যন্ত গরিব। বার্ধক্য ভাতা বা আবাস যোজনার ঘর—কিছুই পাইনি। এই ভাঙা বাড়িতেই প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটে। জন্ম থেকেই ও প্রতিবন্ধী। ওর এখনো বিয়ে হয়নি—এই অবস্থায় মেয়েকে কে বিয়ে করবে?”
বছর কয়েক আগে স্থানীয় ICDS কেন্দ্রের হেল্পারের চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলেন রুমানা। কিন্তু অভিযোগ, তৎকালীন নেতাদের ঘুষ দিতে না পারায় চাকরি হয়নি। এরপরই সমিতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করাই হয়ে ওঠে তার জীবনের বড় লক্ষ্য।
সংগঠনের কাছে রুমানা ‘অমূল্য সম্পদ’
সারা বাংলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির জেলা সম্পাদক নারায়ণ মোহন্ত বলেন,
“রুমানা খুবই কর্মঠ এবং সৎ মেয়ে। তার পরিবার খুবই দরিদ্র হওয়ায় আমরা প্রথম থেকেই তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তার পরিশ্রমের নিরিখে তাকে কমিটির সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“দেখুন কপালের কথা! এত পরিশ্রম করেও একটি সরকারি ট্রাইসাইকেল পর্যন্ত পায়নি রুমানা। অথচ সে এখন অন্যদের জন্য ভাতার আবেদন থেকে শুরু করে কোলকাতা পর্যন্ত ছুটে সরকারি সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। পায়ের সমস্যা থাকায় হাঁটতে কষ্ট হয়, তাই নিজের টাকায় বিশেষ জুতো বানিয়ে নিয়েছে। সে আমাদের সংগঠনের এক অমূল্য সম্পদ।”
অন্যের আনন্দ নিশ্চিত করতে ব্যস্ত, নিজের উৎসবেই অন্ধকার
নিজের দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা ও সরকারি বঞ্চনা সত্ত্বেও রুমানা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সমাজের জন্য। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার রক্ষায় এবং সরকারি সুবিধা পেতে সহায়তায় আজ তিনি জেলার পরিচিত মুখ।
দক্ষিণ দিনাজপুরে তার মতো মানুষ মুঠোমুটো নেই। অনেকেই সরকারি সুবিধা না পেলেও ব্যক্তিগত জীবনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু রুমানা সেই ব্যতিক্রম উদাহরণ, যে নিজের কষ্ট ভুলে অন্যের সুখ নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে |
দক্ষিণ দিনাজপুরের এক দরিদ্র মহিলা, যার উচ্চতা তিন ফুট, হাঁটতে কষ্ট—তবে মনোবল আকাশছোঁয়া।
সরকারি সহায়তা না পেয়েও প্রতিদিন শত শত বিশেষভাবে সক্ষম মানুষকে সাহায্য করার দৃষ্টান্ত তিনি। নিজের জীবনের বঞ্চনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে অন্যের পথ আলোকিত করাই যেন রুমানার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
এমন মানুষের পাশে সরকারের আরও সক্রিয় হওয়া উচিত—এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় মানুষ, সংগঠনের সদস্যরা এবং রুমানার সহকর্মীরা












