এষণা কুন্ডু , পলিটিক্যাল ডেস্ক : ভোর হতেই নড়েচড়ে বসল ডামরা ঘাট। সকাল সকাল অতর্কিত হানা দিলেন আসানসোল দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। অভিযোগ, দামোদরের বুকে নিয়মবহির্ভূতভাবে চলছে অবৈধ বালি উত্তোলন ও পাচার। রাতভর ভারী পোকল্যান্ডের গর্জন ও অতিরিক্ত ওজন বহনকারী ডাম্পারের যাতায়াতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলেই ক্ষোভে উত্তাল স্থানীয়রা। আর সেই অভিযোগ যাচাই করতেই বিধায়কের আকস্মিক অভিযান।
অগ্নিমিত্রা পালের দাবি, বালিঘাটটি বৈধ হলেও এখানে চলছে বেআইনি কার্যকলাপ। সরকারি নিয়মনীতি সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত দামোদরের বুক চিরে বালি তুলে নিয়ে যাচ্ছে মাফিয়া চক্র। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকা, প্রশাসনের উদাসীনতা, এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই এই অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
বিধায়কের কড়া অভিযোগ — “বড় বড় ডাম্পারে বালি তোলা হচ্ছে ওভারলোড করে। গাড়ির নম্বরগুলি বিশেষভাবে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে যেন চিহ্নিত করা না যায়। দামোদরে পোকল্যান্ড নামিয়ে বালি তোলা স্পষ্টতই অবৈধ। প্রশাসন জেনেও ব্যবস্থা নেয় না, কারণ তৃণমূল আশ্রিত মাফিয়ারা এই সিন্ডিকেট চালাচ্ছে।”
অভিযানের সময় জায়গায় দাঁড়িয়েই অগ্নিমিত্রা পাল জানিয়েছেন, জৈনক পাপ্পু ও বিবেক নামে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনি আসানসোল দক্ষিণ থানায় লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, দীর্ঘদিন ধরে এই চক্র একইভাবে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে এনে তিনি বলেছেন — “আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু তৃণমূলের ছত্রছায়া থাকলে কেউ ধরা পড়ে না। বালি-সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েই যাব।”
সূত্রের খবর, অভিযোগ জানানোর পর থানার আধিকারিকরা বিধায়ককে জানিয়েছেন, বালি বোঝাই ট্রাকগুলির নম্বর পাঠিয়ে দিলে অভিযোগ দায়ের হবে। কিন্তু প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন অগ্নিমিত্রা। তিনি বলেন — “অধিকারিকরা না আসা পর্যন্ত আমি এখান থেকে সরছি না। বালি ঘাটেই বসে থাকব। আইনকে উপহাস করতে দেব না।”
ডামরা ঘাটে বিধায়কের উপস্থিতিতে কয়েকটি বালি বোঝাই গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের মধ্যে প্রতিবাদ আরও জোরালো হয়। তাদের বক্তব্য, দামোদরের বালি লুটের জের নিত্যদিন তাদের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বালি তোলার ফলে নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হচ্ছে, নদীর পাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে, এবং গ্রামের রাস্তাঘাট, চাষের জমি ও জলের উৎস ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, মাত্র সাত মাস আগে অবৈধ বালি উত্তোলনের জেরেই ধসে পড়েছিল জল প্রকল্পের সেতু। সেই ঘটনার পর থেকেই আশপাশের প্রায় ৫১টি গ্রামে শুরু হয়েছে জল সংকট। পানীয় জল ও কৃষিকাজের জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল গ্রামবাসীরা আজ পর্যন্ত সঠিক পরিকাঠামো পাননি। ফলে অবৈধভাবে বালি তোলার ঘটনাকে আর মেনে নিতে রাজি নন তারা।
অগ্নিমিত্রা পাল বলেন —
“অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে দামোদরকে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। যে বেআইনি কাজ জল-সঙ্কট, পরিবেশ দূষণ, রাস্তাঘাট ক্ষতি আর মাফিয়া রাজ কায়েম করছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই রাস্তায় নেমে করতেই হবে। বালি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রত্যেক সাধারণ মানুষের ওপর নির্ভর করছি।”
ঘটনার পর ঘাট এলাকায় বিশাল ভিড় জমে যায়। একদিকে বিধায়কের অবস্থান-বিক্ষোভ, অন্যদিকে ডাম্পার চালকদের মধ্যে উত্তেজনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশও ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি বালি তোলা বন্ধ রাখতে প্রাথমিক নির্দেশ দেওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে।
রাজনৈতিক মহলে এই অভিযান ইতিমধ্যেই আলোড়ন ফেলেছে। বিজেপি শিবির অগ্নিমিত্রা পালের পদক্ষেপের প্রশংসা করে দাবি করেছে — আসানসোলে সিন্ডিকেট রাজের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনই একমাত্র পথ। অন্যদিকে তৃণমূল নেতৃত্ব পাল্টা সুরে দাবি করেছে — বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এলাকাকে উত্তপ্ত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, অবৈধ বালি উত্তোলন নিয়ে দামোদর-তীরবর্তী গ্রামগুলিতে বহুদিন ধরেই অসন্তোষ জমছে। নদীর পরিবর্তিত স্রোত, জমি ফাটল, স্কুল-সেতু-রাস্তাঘাটের ক্ষতি, এবং ট্রাক-ডাম্পারের দিনরাতের যাতায়াতে দুর্ঘটনার ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও নতুন নয়।
ঘটনাস্থল থেকেই অগ্নিমিত্রা পালের দৃঢ় হুঁশিয়ারি —
“চাইলে ভয় দেখাক, চাপ দিক — পিছোব না। এই লড়াই অবৈধতার বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য।”
প্রশাসনিক তদন্ত শুরু হলেও ডামরা ঘাটে উত্তেজনা এখনো থামেনি। অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন বিধায়ক।
এখন দেখার বিষয় — অগ্নিমিত্রার অভিযানের পর প্রশাসন সত্যিই কি কঠোর পদক্ষেপ নেয়, নাকি ঘাটে ফের শুরু হয় রাতের আঁধারে বালির লেনদেন।















