এষণা কুন্ডু , পলিটিক্যাল ডেস্ক : স্কুলের ক্লাস চলাকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিতর বসে ভোটার তালিকা সংশোধনের (SIR) কাজ— সেই অভিযোগে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা ছড়াল হাওড়ার সাঁকরাইলের আন্দুল পাঁচপাড়ায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাজি আকবর আলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিতর এই ঘটনা ঘিরে শুরু হয় তীব্র বিক্ষোভ ও চাঞ্চল্য। অভিযোগ, স্কুলের নিয়মিত পঠনপাঠন চলাকালীন বিএলও (Booth Level Officer) ও রাজনৈতিক দলের বিএলএ (Booth Level Agent)রা স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে ভোটার তালিকা সংশোধনের ফর্ম বিলি ও কাজ করছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন – নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে— বিএলওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম সংগ্রহ ও যাচাই করার কথা। অথচ, তা না করে স্কুলের ভিতর বসে ফর্ম বিলি করা হচ্ছে, এমনকি কিছু বিএলএদেরও হাতে ফর্ম ঘাঁটতে দেখা গিয়েছে। এই ঘটনায় এলাকাবাসীর একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে স্কুলে ঢুকে প্রতিবাদ জানালে শুরু হয় হট্টগোল। ফলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে পঠনপাঠন পুরোপুরি ব্যাহত হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আব্দুল কাওসার বলেন, “স্কুলের মধ্যে বিএলও-রা বসে ফর্ম বিলি করছিলেন, আর রাজনৈতিক দলের বিএলএরা তা নাড়াচাড়া করছিলেন। এটা স্পষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনের নিয়ম লঙ্ঘন। ফর্ম তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেওয়ার কথা, স্কুলে এসে এই কাজ করার কোনও অধিকার নেই।”
বৃহস্পতিবার দুপুর প্রায় ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ক্লাস চলাকালীনই কয়েকজন বিএলও ও বিএলএ হাজি আকবর আলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পরই স্থানীয় যুবকেরা স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে চেঁচামেচি শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, বিএলওরা বাড়ি বাড়ি না গিয়ে স্কুল থেকেই এসআইআর-এর ফর্ম বিলি করছেন।
অভিযোগ খারিজ বিএলওর
যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ওই স্কুলের এক বিএলও পূজা মান্না। তাঁর দাবি, “আমরা ফর্ম সাজাচ্ছিলাম, কারও হাতে ফর্ম বিলি করা হয়নি। কিছু স্থানীয় লোক এসে অযথা চেঁচামেচি শুরু করে। আমরা গতকালই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফর্ম দিয়েছি। আজ কেবল ফর্ম গোছানোর কাজ চলছিল।”
একই সুরে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাস কুমার মাইতি জানান, “আমাদের স্কুলের তিনজন শিক্ষক বিএলও হিসেবে কাজ করছেন। বৃহস্পতিবার তাঁরা স্কুলের একটি কক্ষে ফর্ম সাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ কিছু লোক স্কুলে ঢুকে হৈচৈ শুরু করে। এখানে কারও হাতে ফর্ম দেওয়া হয়নি।”
তবে বিরোধী অভিযোগ তুলেছেন এলাকার কিছু রাজনৈতিক কর্মী। তাঁদের দাবি, বিএলওদের সঙ্গে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বিএলএরা মিলে ফর্ম বিলি করছিলেন। দক্ষিণ হাওড়া বিধানসভা কেন্দ্রের ৯৩, ৯৪ ও ৯৫ বুথের বিএলও হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই তিন শিক্ষক একই স্কুলে কাজ করেন, যা নিয়ম অনুযায়ী স্বার্থের সংঘাত তৈরি করতে পারে।
এ বিষয়ে তৃণমূলের এক বিএলএ সুরজ আলি বলেন, “অনেকে সকালে কাজে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে পাওয়া যায় না। তাই কেউ এসে অনুরোধ করলে কয়েকজনকে স্কুল থেকে ফর্ম দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভুল কিছু দেখি না।”
ঘটনার খবর পেয়ে নাজিরগঞ্জ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বেশ কিছুক্ষন চাঞ্চল্য চলার পর পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে বিএলও ও বিএলএরা স্কুল চত্বর থেকে বেরিয়ে যান।
উল্লেখ্য, হাজি আকবর আলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৮২ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ক্লাস চলাকালীনই হঠাৎ এমন ঘটনার ফলে শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকদের একাংশও ঘটনায় বিরক্তি প্রকাশ করে জানান, প্রশাসনের তরফে স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে এই ধরনের সরকারি কাজ করা উচিত নয়।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, এসআইআর (Special Intensive Revision) প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা এবং নাম বাদ বা সংযোজনের আবেদন যাচাই করা। এর জন্য বিএলওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের নির্দেশ রয়েছে। স্কুল বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিতরে এই ধরনের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তীব্র তরজা। বিজেপি অভিযোগ করেছে, তৃণমূলের ছত্রছায়ায় বিএলওরা নিয়ম ভেঙে কাজ করছে, যাতে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে পক্ষপাতিত্ব করা যায়। অন্যদিকে, তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, বিজেপি অযথা প্রশাসনিক কাজকে রাজনৈতিক রঙ দিচ্ছে।
বর্তমানে পুলিশ প্রশাসন ঘটনার রিপোর্ট তৈরি করছে এবং প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, ভবিষ্যতে যেন স্কুলের ভিতর এই ধরনের কাজ না হয়, তার জন্য প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই ঘটনায় আবারও প্রশ্ন উঠেছে— ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো সংবেদনশীল কাজ কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের ক্ষতি করে করা উচিত? নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবে কতটা মানা হচ্ছে, সেই নিয়েই এখন জোর বিতর্ক সাঁকরাইল জুড়ে।
















