এষণা কুন্ডু,পলিটিক্যাল ডেস্ক: সল্টলেকের এক পাঁচতারা হোটেলে গতকাল রাত থেকে দফায় দফায় চলছে বঙ্গ বিজেপির ম্যারাথন বৈঠক। টানা বৈঠক চলছে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষের সঙ্গে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের। আজ সকাল থেকেই কখনও আলাদাভাবে, আবার কখনও একসঙ্গে বসে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে আলোচনা করছেন তিনি। রাজ্যের রাজনৈতিক অন্দরে এই বৈঠক নিয়ে তীব্র জল্পনা তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে সংগঠন মজবুত করা, অন্তর্কলহ প্রশমিত করা থেকে শুরু করে আরএসএসের শতবর্ষ উপলক্ষে কর্মসূচি—সবকিছু নিয়েই চলছে গভীর আলাপ-আলোচনা।
আজকের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বি এল সন্তোষ ছাড়াও রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা—শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, শমীক ভট্টাচার্য, অমিত মালব্য, অমিতাভ চক্রবর্তী, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় সহ আরও কয়েকজন সাংসদ-বিধায়ক। শুধু বিজেপি নেতৃত্ব নয়, বৈঠকে অংশ নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিনিধিরাও। জলধর মাহাতো, শচীন্দ্র নাথ সিনহা, রমা পদ পাল, জিষ্ণু বসু, প্রদীপ জোশি সহ একাধিক শাখা সংগঠনের নেতৃত্বও হাজির ছিলেন আলোচনায়।
দলীয় সূত্রে খবর, গতকাল রাতের বৈঠকে মূলত রাজ্য কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই বঙ্গ বিজেপি রাজ্য কমিটি নিয়ে দোটানায় রয়েছে। কারা থাকবেন নতুন কমিটিতে, নেতৃত্ব কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে, সেই প্রশ্নে দলের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। অন্তরকলহ মিটিয়ে কার্যকর রাজ্য কমিটি দাঁড় করানোই এই মুহূর্তে দলের প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন নেতারা। সূত্রের দাবি, বি এল সন্তোষ স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন—গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে না জড়িয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সমন্বিত লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
এই বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শতবর্ষ উদযাপন কর্মসূচি। বিজয়া দশমীর দিন একশো বছর পূর্ণ করবে সংঘ। সেই উপলক্ষে একাধিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সূত্র বলছে, এই কর্মসূচিগুলিকে কেন্দ্র করে রাজ্যে সাংগঠনিক পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কীভাবে বিজেপি ও সংঘ একসঙ্গে ময়দানে নামবে, কীভাবে ভোটারদের কাছে পৌঁছনো হবে, সে নিয়েই চলছে বিস্তারিত আলোচনা। এর আগে চলতি বছরে উলুবেড়িয়ায় তিনদিন ব্যাপী আরএসএস-বিজেপি সমন্বয় বৈঠক হয়েছিল। আজকের বৈঠক সেই ধারাবাহিকতায়, তবে আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কৌশল আরও স্পষ্ট করতে চাইছে দুই সংগঠন।
রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা, এই বৈঠক কেবল সাংগঠনিক নয়, নীতিগত দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। বিজেপি সূত্রে খবর, বৈঠকে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়েছে এসআইআর (SIR) কার্যকর হওয়ার আগে ও পরে রাজ্যের পরিস্থিতি। বিজেপি নেতাদের ভূমিকা কী হবে, কীভাবে জনসংযোগ বাড়ানো হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন বি এল সন্তোষ। একইসঙ্গে সিএএ (CAA) নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কেন্দ্র ইতিমধ্যেই অবস্থান স্পষ্ট করেছে। রাজ্যে এই ইস্যু কীভাবে কাজে লাগানো যায়, কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মোকাবিলা করা হবে, তাও এই বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রে বলে খবর।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপি বর্তমানে সংগঠন নিয়ে বেশ কিছু সমস্যায় ভুগছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সাফল্যের পরে দলীয় ভেতরেই বিভাজন প্রকট হয়েছে। একদিকে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্ব, অন্যদিকে সুকান্ত মজুমদারের সাংগঠনিক দক্ষতা—দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব বারবার সমস্যায় পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই রাজ্যে নেমেছেন বি এল সন্তোষ। তাঁর উপস্থিতিতে বৈঠক মানে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এক বড় প্রচেষ্টা।
এদিকে আরএসএসের সক্রিয় অংশগ্রহণও তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-আরএসএসের সমন্বয় কতটা কার্যকর হয়, সেটাই নজরে থাকবে। বিজয়া দশমীর কর্মসূচিকে সামনে রেখে আরএসএস ভোটারদের মধ্যে সাংগঠনিক ভিত্তি আরও মজবুত করতে চাইছে। বিজেপি চাইছে সেই প্রভাবকে ভোটে কাজে লাগাতে।
সব মিলিয়ে, বঙ্গ বিজেপির এই ম্যারাথন বৈঠক নিছক সংগঠনীয় বৈঠক নয়, আগামী নির্বাচনের পথ নির্ধারণের দিকনির্দেশ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অন্তর্কলহ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই নামা, আরএসএসের শতবর্ষ কর্মসূচিকে কাজে লাগিয়ে জনসমর্থন আদায়, এসআইআর ও সিএএ ইস্যুকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণ—সব দিক থেকেই এই বৈঠক রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করছে।













